এম ফারুক ইউ চৌধুরী
গত ১৩ এপ্রিল প্রায় নিভৃতেই চলে গেল ভাষাসংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষানুরাগী মুহাম্মদ আব্দুল বাতেনের ১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। আসলে ভাষাসংগ্রামীদের মধ্যে কতজনই বা লাইমলাইটের আলো পান? ১৯৫২ সালে যে শত শত তরুণ রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, তাদের অনেকে জীবিকার প্রয়োজনে ছড়িয়ে পড়েন দেশের বিভিন্ন
মুহাম্মদ আব্দুল বাতেন ১৯৩০ সালের ৩০ অক্টোবর সন্দ্বীপের বাউরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মৌলভী আসাদুল হক এবং মা জেবুন্নেছা বেগম। ১৯৫২ সালের সেই উত্তাল সময়ে ২২ বছরের তরুণ আব্দুল বাতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উর্দু ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের স্নাতক পর্যায়ের ছাত্র ছিলেন। থাকতেন স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। একুশে ফেব্রুয়ারির সকালে বাংলা ভাষার সমর্থনে তৈরি লিফলেট, পোস্টার, ফেস্টুন বহন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কলাভবনমুখী মিছিলে অংশগ্রহণ করে আমতলায় পৌঁছেন এবং ছাত্রসভায় যোগ দেন।
একুশের সেই মর্মন্তুদ ঘটনার পর মেডিকেল হোস্টেলের ‘কন্ট্রোল রুম’ পুলিশ বন্ধ করে দেয়। পরদিন থেকে স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে আন্দোলনের বিকল্প ‘কন্ট্রোল রুম’ প্রতিষ্ঠা হয়। এই ‘কন্ট্রোল রুম’ থেকে বাংলা ভাষার সপক্ষে অনবরত মাইকে জ্বালাময়ী বক্তব্য ও প্রচারণা চলতে থাকে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেওয়ার বাঙালি ছাত্রদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে এক পর্যায়ে উর্দুভাষী ছাত্ররাও উর্দুতে বক্তব্য দিতে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের বাংলাভাষী ছাত্র আব্দুল বাতেনও উর্দুভাষী ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার যৌক্তিকতা তুলে ধরে উর্দুতে বক্তব্য দেন।
স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভেতর থেকে ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে বিভিন্ন বক্তব্য এবং মাইকিং ২৬ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো আকস্মিক তল্লাশি, আন্দোলনে সংশ্লিষ্টদের ধরপাকড়, হল বন্ধের সরকারি পরিকল্পনা এবং পুলিশি অভিযানের আগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বিকল্প কন্ট্রোল রুমে আব্দুল বাতেনের সক্রিয় অংশগ্রহণ স্বাভাবিকভাবেই গোয়েন্দাদের নজরদারিতে পড়ে। হল তল্লাশির আগাম তথ্য পেয়ে গ্রেপ্তারের ঝুঁকি এড়ানোর জন্য আব্দুল বাতেন আত্মগোপনে চলে যান। ওদিকে ঢাকায় একুশে ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণ, হতাহত, হল তল্লাশি এবং ছেলে আব্দুল বাতেনের আত্মগোপন ইত্যাদি সংবাদ তাঁর বাবার কাছে পৌঁছলে পরিস্থিতি অত্যন্ত গুরুতর উপলব্ধি করে মৌলভী আসাদুল হক গ্রামের বাড়ি সন্দ্বীপ থেকে ঢাকায় ছুটে যান এবং ছেলেকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৪ সালে এমএ পাস করে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। ভারত, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের পাকিস্তান মিশনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ পদে কাজ করার পর তিনি ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বদলি হন এবং এখান
থেকে ১৯৮৭ সালে উপপরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি যখন জাতিসংঘের পাকিস্তান মিশনে কর্মরত, দেশে তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে।
৮ অক্টোবর তিনি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণের পর এই মহান ভাষাসংগ্রামী ১৯৯১ সালে মায়ের স্মৃতিরক্ষায় চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির বাগান বাজার ইউনিয়নের গজারিয়া জেবুন্নেছা পাড়া গ্রামে ‘গজারিয়া জেবুন্নেছা পাড়া উচ্চ বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ফটিকছড়িতেই শেষ জীবন অতিবাহিত করেন।
ডা. এম ফারুক ইউ চৌধুরী:
লেখক, গবেষক এবং বিশ্ব
স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক কনসালট্যান্ট
faruqchy@gmail.com
ঢাকানিউজ২৪.কম / এইচ
আপনার মতামত লিখুন: