নিউজ ডেস্ক : স্বাধীনতার ৪৭ বছর। তিরিশ লাখ প্রাণ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পেরিয়ে দেশ আজ বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। নানা চড়াই-উতরাই আর প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে অদম্য বাংলাদেশ। জাতির প্রত্যাশার সঙ্গে সব ক্ষেত্রে প্রাপ্তির পরিপূর্ণতা না পেলেও অর্জন, উৎপাদন আর সক্ষমতায় বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়াটাও রীতিমতো এক বিস্ময়।
রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চাপ সব মিলিয়ে উন্নয়নের ধারা বাধাগ্রস্ত হয়েছে বারবার। কিন্তু তার পরও এগিয়ে গেছে দেশ। অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কাছে রোলমডেল। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ, তরুণ ও নতুন উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ, উন্নয়নশীল দেশের শর্ত পূরণ, জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধি, রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধি, রেকর্ড পরিমাণ রিজার্ভ সবই দেশের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। বেড়েছে কর্মসংস্থানের হার। কৃষি খাতেও যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। বেড়েছে কৃষি খাতে বিনিয়োগ ও গড় মজুরির পরিমাণও। দারিদ্র্যের হার কমেছে। নানা অন্তরায় ও মন্দার প্রতিকূলতা ঠেলেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অর্জনের ফল, স্বপ্নজয়ের আকাক্সক্ষা আর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি। গত ১৭ মার্চ জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) এ ঘোষণা সংক্রান্ত চিঠি জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেনের কাছে হস্তান্তর করেছে। ৪৭ বছরের বাংলাদেশের এ এক বড় প্রাপ্তি। সূত্র জানায়, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে কোনো দেশকে বের হতে হলে মানবসম্পদ উন্নয়ন, অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক ও জাতীয় মাথাপিছু আয়ের (জিএনআই) হিসাবে নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হয়। এর মধ্যে মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে কমপক্ষে ১০০-এর মধ্যে ৬৬ পয়েন্ট পেতে হবে। বাংলাদেশ এ সূচকে অর্জন করেছে ৬৮ দশমিক ৭ পয়েন্ট। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে অবস্থান জাতিসংঘের নির্ধারিত মানের ওপরে। জাতিসংঘের হিসাবে এই সূচকে কোনো দেশের অবস্থান ৩২ পয়েন্টের কম থাকতে হবে। জাতিসংঘের হিসাবেও দেশের অবস্থান ২৫ দশমিক ১১ পয়েন্ট। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হতে হলে জাতীয় মাথাপিছু আয় কমপক্ষে ১ হাজার ২৪২ মার্কিন ডলার থাকতে হবে। বর্তমানে এই আয় ১ হাজার ৬১০ ডলার। এই খাতেও নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। এই ঘোষণার পর বাংলাদেশ এখন থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে চলে এলো। তবে এটি কার্যকর হবে আগামী ২০২৪ সাল থেকে।
প্রায় শতকরা ৮৮ ভাগ দরিদ্র জনগোষ্ঠী নিয়ে শুরু করা বাংলাদেশ এখন স্বপ্ন দেখছে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার। ২০৫০ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে নাম লেখাতে যে চেষ্টা আর উদ্যম ছোট্ট এই ভূখন্ডে, তাকে বড় কোনো স্বপ্ন নয় বলেই মনে করছেন বিশ্ব অর্থনীতির বিশ্লেষকরা।
এলডিসি থেকে বের হতে হলে এর প্রাথমিক কাজটি করবে জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসোক) আওতাধীন কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। ইতোমধ্যে তাদের কাছে বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশন থেকে এসব তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তারাও তাদের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
প্রবাসে শ্রম, ঘাম আর মেধায় বিশ্বজুড়ে নিজেদের অবস্থানের সঙ্গে প্রিয় দেশটিকে গর্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন কোটি মানুষ। বর্তমান সময়ে জনশক্তি রপ্তানিতে আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। গেল বছর বাংলাদেশের ১০ লাখেরও বেশি শ্রমিক গেছেন বিভিন্ন দেশে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক গেছেন সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায়। এ দুটি দেশে শ্রমিক যাওয়ার পরিমাণ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি সিঙ্গাপুর, কাতার, ওমানেও আগের তুলনায় বেশি শ্রমিক গেছেন। কিছু নতুন বাজারও সৃষ্টি হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশে দক্ষ জনশক্তি তৈরির ওপর কিছুটা জোর দেওয়া হয়েছে, তবে তা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করা গেলে বিদেশে তাদের উপার্জন বাড়ে, দেশেও তারা অনেক বেশি পরিমাণে অর্থ পাঠাতে পারে। জনশক্তি রপ্তানির সুযোগও বাড়ে।
বিদেশি সাহায্য ছাড়াই দেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো স্বপ্নের পদ্মা সেতু প্রকল্প এখন আর স্বপ্ন নয়; মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শুরু করেছে। ঢাকার পথে মেট্রোরেলের স্বপ্ন এখন বাস্তবে রূপ লাভ করতে চলেছে। যোগাযোগ আর প্রযুক্তি খাতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে চার লেনের বেশ কয়েকটি মহাসড়ক আর এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে নির্মাণের।
কয়েক বছর ধীরগতিতে থাকা রেমিট্যান্স গতি ফিরে পেয়েছে এ মাসে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এসেছে ১১৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার, যা গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারির চেয়ে প্রায় ২২ দশমিক ১৩ শতাংশ বেশি। আলোচ্য সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ৯৪ কোটি ৭ লাখ ডলার। বাংলাদেশের জিডিপিতে ১২ শতাংশ অবদান রাখা প্রবাসীদের পাঠানো এই বৈদেশিক মুদ্রার অর্ধেকের বেশি আসে মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, কুয়েত ও বাহরাইন থেকে। ৩৯টি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৮৪ কোটি ৫ লাখ ডলার। ৯টি বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১ কোটি ২৬ লাখ ডলার। সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে বেসরকারি ইসলামি ব্যাংকের মাধ্যমেÑ ২৩ কোটি ডলার।
অবহেলিত জনগোষ্ঠীর পরিশ্রমের ফসল পোশাকশিল্প এখন বিশ্বজুড়ে ব্র্যান্ড বাংলাদেশ। এই সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে ধারাবাহিক উন্নতি বিশ্বের বুকে দেশকে পরিচয় করিয়েছে উজ্জ্বল এক সম্ভাবনা হিসেবে। নতুন নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন করার ফলে এবং বিগত কয়েক বছরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
অর্থনৈতিক খাতের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, বাজেটের আকার, মাথাপিছু আয়, রপ্তানি আয়, শিল্প উৎপাদন, কৃষি উৎপাদন, সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ, রাজস্ব আয়, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, অবকাঠামোর উন্নয়ন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণসহ বিভিন্ন খাতে এসেছে সফলতা। সামাজিক খাতের মধ্যে দারিদ্র্য, শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু, অপুষ্টির হার কমেছে। যোগাযোগ কাঠামো, চিকিৎসা সেবা, শিক্ষার হার, নারীর ক্ষমতায়ন বেড়েছে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে পেশ করা স্বাধীন দেশের প্রথম বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। ৪৫ বছরে বার্ষিক বাজেটের আকার এখন ৪ লাখ কোটি টাকায় ছাড়িয়েছে। আর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে তা ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২ কোটি ডলার। এখন তা বেড়ে ৩ হাজার ২০০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। তখন মাথাপিছু আয় ছিল ১২৯ ডলার। এখন বেড়ে ১ হাজার ৬১০ ডলারে দাঁড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৪৭ শতাংশ, এখন যা কমে ৫ শতাংশে নেমেছে। স্বাধীনতার পর প্রথম অর্থবছরে মোট রপ্তানি আয় ছিল ৩৩ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরে এর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৭০০ কোটি ডলার।
১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে মোট খাদ্য উৎপাদন ছিল ৯৯ লাখ ৩০ হাজার টন। এখন খাদ্যশস্য উৎপাদন সাড়ে ৩ কোটি টন ছাড়িয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর দেশের ৮৮ শতাংশ মানুষ ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৪.৮ শতাংশে। ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে যেখানে মোট কর্মজীবীর মাত্র ৭ শতাংশ ছিল নারী, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৩০ শতাংশ। অতিদরিদ্রের সংখ্যা নেমে দাঁড়িয়েছে ৭ শতাংশে।
বাংলাদেশের প্রথম নিবন্ধিত ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে সনদ পেয়েছে জামদানি ও ইলিশ মাছ। ফলে এ দুটি পণ্যের স্বত্ব কেবলই বাংলাদেশের। ভারত স্বত্ব দাবি করলেও এই সনদের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো। ফলে এখন থেকে ইলিশ ও জামদানি বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে সারাবিশ্বে পরিচিত হবে। এরই মধ্যে জিআই পণ্য হিসেবে ইলিশ ও জামদানির নিবন্ধনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।
অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো স্বাধীনতার ৪৭ বছরের ক্রীড়াজগৎও এগিয়ে গেছে। সব ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত উন্নতি না হলেও ক্রিকেট এখন বাংলাদেশের গর্বের বিষয়। যে কয়টি বিষয় নিয়ে গর্ব করতে পারে, তার মধ্যে ক্রিকেট একটি। ক্রিকেটবিশ্ব এখন সমীহ করে বাংলাদেশকে।
তথ্যপ্রযুক্তি ও এ সংক্রান্ত সেবা খাতে (আইটি-আইটিইএস) বাংলাদেশের সম্ভাবনা ব্যাপক। এই ক্ষেত্রটিতে বিশ্বের অন্যতম প্রবৃদ্ধির হার এখন বাংলাদেশে। তাই এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগের ব্যাপক সম্ভাবনা ও সুযোগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক গবেষণা সংস্থা বলছে, ২০২৫ সাল নাগাদ এই বিনিয়োগ প্রায় ৪৮০ কোটি মার্কিন ডলারের কম হবে না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সাল নাগাদ তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাতে আয় ২৩০ কোটি মার্কিন ডলারের কম হবে না। বাংলাদেশে হার্ডওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাতের দ্রুত বৃদ্ধি এ খাতকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশে কম খরচে ব্যবসা করার সুবিধা এবং কম খরচে কর্মী পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া দক্ষ কর্মী তৈরিতে বাংলাদেশের আগ্রহ দেশটিকে আরও সম্ভাবনাময় করে তুলছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোয় আইটি-আইটিএস সেবা দেওয়া হচ্ছে।
স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে বিস্ময়কর অর্জন এসেছে নানা ক্ষেত্রে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, অসম্ভব প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর পরিশ্রমী উদ্যমী মানুষের চেষ্টায় দেশ এগোলেও সেভাবে এগোয়নি দেশের রাজনীতি। বিরোধপূর্ণ ও হিংসাপ্রবণ রাজনীতি বরাবরই পেছনে টেনে রেখেছে অগ্রযাত্রার গতি। ১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর এর গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার শুরু হলেও তাতে মাঝপথে ছেদ পড়ে ওয়ান-ইলেভেনের সময়। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, সব ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আর সুষ্ঠু ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠলে অমিত সম্ভাবনার বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে উন্নয়ন আর অগ্রগতির অনন্য এক উদাহরণ।