বিশ্বজিৎ বসু
সময় ১৯৮৮, ফেব্রুয়ারি মাস। এরশাদের পদত্যাগের দাবিতে আটদল, সাত দল, পাঁচ দলের ব্যানারে চলছে আন্দোলন। আজ হরতাল, কাল সমাবেশ, পরশু মিছিল। রাজনৈতিক কর্মীদের কারো নামে হুলিয়া, কেউ জেলে, কেউ বা জামিনে।
চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে জোটের জনসমাবেশ। প্রধান অতিথি শেখ হাসিনা। সেখান থেকে আন্দোলনের কি ঘোষণা আছে সেটা জানার জন্য সকাল থেকেই উৎসুক ফরিদপুর শহরের কর্মীরা। দুপুর থেকেই হঠাৎ করে শহরে বেড়ে যায় পুলিশের টহল। জনতা ব্যাংকের মোড়ে বেড়ে যায় পুলিশের টহল। ট্রাকে করে পুলিশ টহল দিতে থাকে শেহরের এমাথা থেকে অন্য মাথায়। পুলিশের মধ্যে একধরণের যুদ্ধংদেহী ভাব।
টহল পুলিশের গাড়ির ড্রাইভার হারাণ বাবু একটি ল্যান্ড রোভার গাড়ি চালিয়ে সামনে পিছনে পুলিশ নিয়ে সারা শহর টহল দিয়ে বেড়ায়। রাজনৈতিক নেতা কর্মিীদের কাছে সে পরিচিত। সেও শহরের অলিগলি চেনার সাথে রাজপথে যারা মিছিল মিটিং করে বেড়ায় তাদেরও কম বেশী চিনে। অপরাধীদের গ্রেফতারে তিনি পটু হলেও পুলিশের হাত থেকে রাজনৈতিক কর্মিদের বাঁচনোর জন্য সুযোগ পেলেই তিনি সেটা করেন। বিশেষ করে মিছিল মিটিং বা হরতালে যখন পুলিশ একশনে যাবার প্রস্তুতি নেয়, হারাণ বাবু তখন এক বা হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে ডান হাত বের করে দেয় গাড়ির জানালার দিয়ে, তারপর ক্রমাগত হাত নাড়িয়ে মিছিলকারীদের সরে যাবার সংকেত দিতে থাকে।
এদিন দুপুর বেলা রাস্তায় দাঁড়ানো ছিল ভুলু। তাকে দেখে গাড়ি থেকে নেমে আসেন হারাণ বাবু। এসে বললেন, ‚আপনাদের জন্য দুঃসংবাদ। চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার সমাবেশে গুলি হয়েছে, ক্যাজুয়ালিটি একশোর কাছাকাছি, চব্বিশ জন অলরেডি ডেথ। রাতে ধরপাকড় হতে পারে, সতর্ক হয়ে যান।“ পুলিশের কাছে খবর শোনার পর ভুলুর মনে হচ্ছিল সে চিৎকার করে দু:সংবাদটা সকলকে জানিয়ে দেয়। কিন্তু আবার ভাবে যদি খবরটা মিথ্যা হয়। তাহলে সেটা আরও খারাপ কিছু হয়ে যাবে। সে হাঁটা দেয় বাড়ির দিকে। পথে পরিচিত যাকে পেতে থাকে তার কাছেই ফিস ফিস করে পৌঁছে দিতে থাকে খবরটা।
দেশের রাষ্ট্রীয় রেডিও বা টেলিভিশন হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারের মুখপাত্র।
এখানে শুধু সরকারের গুণগান আর সরকারী দলের খবর। সঠিক খবর শুনতে হলে সন্ধ্যায় বিবিসির খবর পর্যন্ত অপেক্ষা ছাড়া উপায় নাই। আর তা না হলে পরের দিনের খবরের কাগজ। যদিও খবরের কাগজের উপরও কোন ভরসা নাই। কারণ সরকার মাঝে মাঝেই খবরের কাগজে উপর নিষেধাজ্ঞাও দিয়ে বসে বিশেষ কোন খবর না ছাপানোর জন্য। চট্টগ্রামের মিছিলে গুলিও সে রকাম একটি খবর। ১৯৮৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারির ছাত্রদের উপর গুলির খবরও ছাপতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল সরকার।
বর্তমানে তাৎক্ষণিক আন্দোলনের কর্মসূচিও পালন হয় এই বিবিসির খবর শুনেই। কেন্দ্র থেকে আন্দোলনের যে কর্মসূচি দেয়া হয়, সেগুলো খবর পাঠের মধ্য দিয়ে সারাদেশে পৌঁছে দেন বিবিসি বাংলাদেশের প্রতিনিধি আতাউস সামাদ। জেলার রাজনৈতিক নেতারাও অপেক্ষা করে কখন সাড়ে সাতটা বাজবে, বিবিসির খবর শোনা যাবে।
সন্ধ্যায় রাজনৈতিক পাড়ায় কেমন যেন একটা ছমছমে ভাব, সবাই যেন সদা সতর্ক। নেতা কর্মীদের আনাগোনা অন্যদিনে তুলনায় বেশ কম। ভুলু সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে জনতা ব্যাংকের মোড়ে, রমজানের তুলার দোকানে বিবিসির খবর শোনার জন্য।
ভুলু পৌঁছার কিছুক্ষণ পর শুরু হয় খবর। খবর চলতে চলতে সেখানে এসে পৌঁছায় বিভুল, বিশু, এনাম, লায়েক সহ আরো কয়েকজন। সবাই পাশাপশি দাঁড়িয়ে খবর শোনে। হ্যাঁ ঘটনা সত্য। চট্টগ্রামে লালদীঘি ময়দানে শেখ হাসিনার সমাবেশে গুলি হয়েছে, ২৪ জন মারা গেছে গুলিতে। কিন্তু নতুন কোন কর্মসূচি ঘোষণা হয নাই। শেখ হাসিনা চ্ট্টগাম থেকে ফিরে এলে কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
কোন কর্মসূচি না থাকায় সবাই একটু হতাশ। ভুলু বললো, চলো নেতার কাছে যাই। যেহেতু কেন্দ্রীয় কোন কর্মসূচি এখনও ঘোষণা দেয় নাই, আমাদের এখন কি করা উচিত, তিনি কী বলেন। ভুলু সবার মধ্যে সিনিয়র। তার প্রস্তাবে সবাই রাজি হয়ে হাঁটা শুরু করলো নেতার বাড়ির দিকে।
নেতা কিছুদিন আগে সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছেন। আগের সভাপতিকে ভোটে হারিয়ে সভাপতি। কর্মীদের কাছে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। এর আগে এমপি ছিলেন দুই বার। সামনে নির্বাচন এলে তার সিটে তার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নাই।
পাঁচজন একেবারে মিছিলের গতিতে যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে আলো আঁধারির মধ্যে দিয়ে মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে গেল নেতার বাড়ি।
সকলে যখন নেতার বাড়ি পৌঁছে তখন তিনি একটি কাশ্মীরী শাল গায়ে জড়িয়ে চেয়ারে বসে বই থেকে একটি সাদা কাগজে নোট নিচ্ছিলেন। মুখের অবয়ব দেখে মনে হচ্ছিল না চট্টগ্রামের কোন খবর তিনি জানেন, নিলিপ্ত, নির্বিকার। চশমার আড়াল দিয়ে চোখ দেখে মনে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছিল কোন দুঃশ্চিন্তা তাকে ভর করেনি।
নেতা সাধারণত খুব শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন, খাইনি, বলিনি, চলিনি এরকম অনেকটা শান্তিপুরী স্টাইলে। এ বিষয়ে তার মত, নেতা হতে হলে তোমাকে দেখাতে হবে তুমি অন্যদের চেয়ে আলাদা। সেটা রুচিতে, বুদ্ধিতে, জ্ঞানে, কথায় এবং কাজে। নাহলে সাধারণ মানুষ বুঝবে কীভাবে তুমি সাধারণের চেয়ে আলাদা। বক্তৃতা দেবার সময়ও প্রমিত বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দেন।
হঠাৎ তার বাড়িতে চার পাঁচজন কর্মী দেখে তিনি যেন চমকে উঠলেন এবং নোট নেয়া বন্ধ রেখে, একেবারে প্রমিত বাংলা উচ্চারণে জিজ্ঞাসা করলেন, কী চাই!
ভুলু, ছালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করে, লিডার চট্টগ্রামের খবর তো শুনেছেন?
– হ্যাঁ, শুনেছি।
– আমাদের এখন কী করা উচিত। কেন্দ্রীয় কোন কর্মসূচিতো নাই।
ভুলুর এই কথা শোনার পর নেতা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললেন, তোমারা কী আমাকে রাতে বাসায় নিরিবিলিতে ঘুমাতেও দেবে না। তোমরা কী চাও কোর্টে টুকটাক প্রাকটিস করে সংসারটা চালাই, সেটাও বন্ধ হয়ে যাক।
ভুলু একটু বিব্রত, বড় আশা করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাথে যুক্ত আরো দুটি সংগঠনের নেতা কর্মীকে সাথে করে নিয়ে এসেছে। সে আবারো জিজ্ঞেস করলো, তাহলে আমরা কী করবো?
– তোমরা কী করবে সেটা আমি কি করে বলবো? এবার নেতা উত্তর দিলেন।
– তাহলে আমরা উঠি? হতাশ হয়ে ভুলু জিজ্ঞেস করে।
– ঠিক আছে, আসো! নেতা উত্তর দেয়।
একরাশ হতাশা নিয়ে ভুলুরা বের হয়ে আসে নেতার ঘর থেকে। অন্ধকার চিকন গলি, দুরের ল্যাম্প পোস্টের আলো গাছের পাতার মধ্যে দিয়ে যেটুকু পড়ছে তাই দিয়ে বুঝে নিতে হচ্ছে পথ। এ যেন দেশের অন্ধকারময় পথে যেখানে যেটুকু আলো আছে তা দেখে এগিয়ে চলার মতো। মুল রাস্তা বাদ দিয়ে বাড়ির পিছনে ঝোঁপের মধ্যে দিয়েই সকলে এসেছিল নেতার বাড়ি।
হাঁটা পথ থেকে বের হলে কংক্রিটের রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে দু-তিন বার ডান বাম ডান বাম করে সকলে পৌঁছায় দীঘীর পারে। হঠাৎ তাদের কানে ভেসে আসে একটি ককটেলের আওয়াজ। রাতের বেলা মনে হচ্ছিল শব্দটি আসছে জেলাখানার দিক থেকে। ঐ এলাকায় কোন দোকান পাঠ নাই। সন্ধ্যার পর রাস্তাটা সাধারণত নিরব জনমানবহীন। দীঘীরউত্তর পারে অম্বিকা ময়দানে শহীদ মিনারের পাদদেশে পৌঁছাতেই দেখা গেল একজন লোক মাঠের মধ্যে দিয়ে হেঁটে আসছে। কাছাকাছি আসতেই বোঝা গেল তিনি আরেক যুগ্মনেতা। তিনি সাধারণ সম্পাদকের যুগ্ম। একটু দুর থেকেই তিনি হাঁক দিলেন, কেরে?
– আমরা লিডার, ভুলু উত্তর দিলো।
– আমরা কিডা ! নাম নাই। বলতে বলতে যুগ্মনেতা পৌঁছে গেলেন ভুলুদের সামনে। দুরের ল্যাম্প পোস্টের আলোয় যতটুকু মুখ দেখা যাচ্ছিল, তাতেই তিনি চিনে ফেলেন সকলকে। দেখেই তার মেজাজও তিরিক্ষি হয়ে গেল। ধমকের সুরে বলে উঠলেন, ‚এই শুয়োরের বাচ্চারা, এখানে কি করছিস, আন্দোলন মারাতে আইছিস।“
ভুলু কিছু বলতে চাচ্ছিল। যুগ্মনেতা সে কথার কোন সুযোগ না দিয়ে বলে উঠলো, ভাগ শালারা, আন্দোলন মারান লাগবে না। যা, বাসায় যা। তারপর হাঁটা দিয়ে বির বির করে বলতে লাগলেন, ‚পুলিশ ধরলে হুগার মধ্যে দিয়ে আন্দোলন বাইর করে দিবেনে। শালারা আন্দোলন মারতে আইছে।“ বেগুন বেচার মতো মুখ করে সবাই শুনতে থাকলো যুগ্মনেতার গালাগাল। কিছুদুর পর গিয়ে যুগ্মনেতা ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার ধমক, ‚ শুয়োরের বাচ্চারা এখনও দাঁড়ায়ে আছিস, যা বাড়ি যা।“
সকলে হাঁটা দিলো বাড়ির দিকে। ভুলু দুঃখ করে শুধু বললো, কি বলবো বিশু তোমাকে। আমার নেত্রীর মিছিলে গুলি করলো, আমার নেতারা যদি এরকম হয়, তোমাকে কীভাবে বলি আন্দোলন করতে।
বিশু উত্তর দিল, চলেন বাড়ি যায়। আন্দোলন করতে এসে ভালই পুতিরস্কার পেলাম। এই শুয়োরের বাচ্চা গাল সারাজীবন মনে থাকবে।