নিউজ ডেস্ক: সমাজকল্যাণ মন্ত্রী রাশেদ খান মেমন বলেছেন, ১৯৭৪ সালের শিশু আইনে আগামী অধিবেশনেই প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে। সংশোধিত নতুন আইনে শিশু আদালত প্রচলিত আদালত থেকে সম্পূর্ণ আলাদা থাকবে। তাছাড়া বিদ্যমান শিশু আদালত সমূহ সংস্কারেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
রবিবার দুপুরে দৈনিক ইত্তেফাকের মাজেদা বেগম মিলনায়তনে আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ‘বাংলাদেশর শিশু সুরক্ষা ও উন্নয়ন: এসওএস শিশু পল্লীর ভুমিকা’ শীর্ষক এই গোলটেবিল আলোচনার যৌথভাবে আয়োজন করে দৈনিক ইত্তেফাক ও এসওএস শিশু পল্লী। যেখানে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা শিশু সুরক্ষা বিষয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেন।
রাশেদ খান মেনন বলেন, আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ ঐতিহ্যগতভাবেই শিশু বান্ধব। আমরা পরিবারের মাধ্যমে শিশুকাল থেকে যত্ন সহকারে বড় হয়েছি। সেই বিষয়টি উপলব্ধি করেই ১৯৭৪ সালে জাতির জনক শিশু আইন করেছিলেন। পরিবর্তিত ব্যবস্থায় শিশু নির্যাতনের ধরন পাল্টেছে। তাই এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এসেছে। সে্ই লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কারে সরকার কাজ করছে।
মাতৃপিতৃহীন ও এতিম শিশুদের বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে মেনন বলেন, আমাদের সরকারি উদ্যোগে এতিমখানায় মাতৃপিতৃহীন ৮৫টি পরিবার আছে। তারা আশপাশের সাধারণ স্কুলগুলোতেই অন্যদের সঙ্গে পড়াশুনা করে। এমনকি সেখানে বড় হওয়া মেয়ে শিশুদের শিক্ষা ও কাজের পাশাপাশি বিয়ের ব্যবস্থাও করা হয়। তবে বেসরকারি এতিমখানা সমূহ কোনও নিয়মের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয় না। সেখানে শুধু ধর্মীয় শিক্ষাই দেয়া হয়। তাই এসব এতিমখানার অবকাঠামোগত উন্নয়নে সরকার প্রয়োজনীয় বরাদ্দের কথা ভাবছে। যাতে এসব শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থাও করা যায়।
মেয়েদের জন্য সরকারের উপবৃত্তি কার্যক্রমের কথা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, এখন মোবাইলের মাধ্যমে মেয়েদের কাছে সরাসরি বৃত্তি পৌঁছে যায়। তাই কন্যাশিশুরা এখন আর অন্যের বাড়িতে বা গার্মেন্টসে কাজের পরিবর্তে স্কুলমুখী হয়। আমরা দেখি প্রাথমিকে এখন মেয়েদের শিক্ষার হার ৫২ শতাংশ।
তবে শিশুদের অপরাধে জড়ানোর কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, আমরা এখনও পর্যন্ত অনেক কিছু করতে পারিনি। বিশেষ করে পথশিশুদের জন্য গৃহীত পদক্ষেপ সমূহ এখনও সেভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। কারণ তাদের থাকার জন্য পুনর্বাসন সেন্টার নির্মাণের কাজ এখনও শেষ হয়নি। সেই সুযোগে এসব শিশুকে অনেকে মাদক বা অবৈধ অস্ত্র বহনের কাজে ব্যবহার করে।
শিশুদের জন্য প্রত্যেক বিভাগে একটি করে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র নির্মাণের বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন বলে জানান সমাজকল্যাণ মন্ত্রী। শিশুদের প্রযুক্তির প্রতি অতিমাত্রায় আসক্তিকেও তিনি উদ্বেগের বলে উল্লেখ করেন। তাছাড়া শিশুদের জন্য আলাদা অধিদফতর নির্মাণে বেসরকারি সংস্থার দাবির বিষয়টিও বিবেচনার আশ্বাস দেন মন্ত্রী।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সংসদ সদস্য জেবুন্নেছা আফরোজ বলেন, ২০১৬-১৭ সালে প্রথমবারের মতো বাজেটে শিশুদের জন্য আলাদা করে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
শিশুদের বিকাশে গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, প্রথম সারির পত্রিকায় শিশুদের জন্য ছুটির দিনে একটি পাতা রাখা প্রয়োজন। তাছাড়া যারা পরিচালক আছেন তারা তাদের শিশুতোষ মুভি নির্মাণের বিষয়টি বিবেচনা করা দরকার। বছরে অন্তত একটি ভালো মানের শিশুতোষ মুভি নির্মাণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
অনুষ্ঠানে পুলিশের ডিআইজি ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান বলেন, সচেতনতা যদি না থাকে তবে শুধু আইন দিয়ে শিশুদের সুরক্ষা দেয়া সম্ভব না। শিশু আইনের আলোকে দেশের প্রত্যেক থানায় একজন করে অফিসার বিশেষভাবে শিশুদের প্রতি সহিংসতা নিয়ে কাজ করেন। তথাপি কোনও সমস্যা কোথাও থাকলে পুলিশকে জানাবেন।
তিনি বলেন, আমরা খুনের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখেছি, সবচেয়ে বেশি খুন হয় পারিবারিক সহিংসতার কারণে। আত্মহত্যার ঘটনায়ও ছেলেমেয়ের পরিমান প্রায় সমান। এর মূল কারণ পারিবারিক বন্ধন আমাদের দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। বিবাহ বিচ্ছেদের পরিমাণ বৃদ্ধিও পারিবারিক সহিংসতার কারণ। ভেঙে যাওয়া পরিবার থেকে আসা ছেলেমেয়েদেরই অপরাধে জড়ানোর হার সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ শিশু একাডেমির পরিচালক আনজির লিটন বলেন, স্বাধীনতার পর শিশুদের নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে। কিন্তু আমরা সবকিছু ইতিবাচকভাবে দেখতে পারি না। এই শিশুদের জন্য বিনামূল্যে বই বিতরণ করছে সরকার। শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য শিশু হাসপাতাল করা হয়েছে। তাছাড়া কন্যা শিশুদের শিক্ষার জন্য উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব আমাদের অর্জন। তবে আমাদের এ নিয়ে আরও কাজ করার সুযোগ আছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের উপ-পরিচালক এম. রবিউল ইসলাম বলেন, শিশুদের রাজনৈতিক সহিংসতায় না জড়াতে গত জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনকে মানবাধিকার কমিশন থেকে চিঠি দেয়া হয়। নির্বাচন কমিশনও তাদের প্রত্যেকটা অফিসে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়। কিন্তু বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা ছাড়া শিশুদের রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা বলেন, দেশে যথেষ্ট পরিমান আইন আছে। তবে সেসব আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই। তাই শুধু আইন করলেই হবে না, এর যথাযথ পয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে সামাজিক সচেতনতাও প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এস এম আতিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের ৬ কোটির বেশি শিশু রয়েছে এখন। শিশুরা বৈশ্বিক সম্পদ। এই শিশুদেরকে জনসম্পদে রূপান্তর করতে হবে।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য রাখেন এসওএস শিশু পল্লীর ন্যাশনাল ডিরেক্টর গোলাম আহমেদ ইসহাক। পরে বিষয়ের উপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির ডিরেক্টর ও শিশু ন্যাশনাল ফোকাল পারসন চায়না রানী সাহা। তিনি এসওএস শিশু পল্লীর বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরেন।
এছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাছিমা বেগম এনডিসি, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারম্যান ড. খাজা শামসুল হুদা, কবি ও গণমাধ্যম কর্মী তাহমিনা শিল্পী, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এর কর্মসূচির সমন্বয়কারী আব্দুল আল মামুন, সেভ দ্য চিলড্রেনের ম্যানেজার (শিশু সুরক্ষা) মো. ইকরামুল কবীর এবং এসওএস শিশু পল্লীর উপ-পরিচালক এনামুল হক।
অসুস্থতার কারণে দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক তাসমিমা হোসেনের অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পত্রিকার সিটি এডিটর আবুল খায়ের। তিনি সমাপনী বক্তব্যে অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের ধন্যবাদ জানান।
অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র রিপোর্টার আসিফুর রহমান সাগর।