নিউজ ডেস্ক: জাতীয় নির্বাচনে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যাতে বর্তমানের মতো নিয়ন্ত্রণে থাকে সেজন্য ডিসিদের নির্দেশ দিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। সার-বীজ কীটনাশক বিতরণে সার্বক্ষণিক তদারকিতে তাগিদ দিয়েছেন কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন। পানিসম্পদ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি দক্ষ মানব সম্পদ তৈরির উপর জোর দিয়েছেন। পাহাড় কাটা রোধ আর ধসে ডিসিদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন পরিবেশ বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। সরকার জিরো হাঙ্গার পলিসি গ্রহণ করেছে বলে উল্লেখ করেছেন খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম।
তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে গতকাল মন্ত্রণালয়ভিত্তিক কার্য অধিবেশনে মন্ত্রীরা পৃথকভাবে এ সব কথা বলেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এ সব আলোচনার বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। মন্ত্রীরা আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে যে বিষয় বলেছেন তাই সংক্ষিপ্তভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।
শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু: শিল্পমন্ত্রী সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে আছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এভাবে যেনো নিয়ন্ত্রণে থাকে ডিসিদের সে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মাদক নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত রাখতে ডিসিদের বলা হয়েছে জানিয়ে শিল্পমন্ত্রী বলেন, ‘মাদক ব্যবসায়ী ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত যেই হোক কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশ দিয়েছেন সেটা যেনো বাস্তবায়ন হয়।’ ডিসিদের আরো বলা হয়েছে, আগামী আখ মৌসুমে আখ দিয়ে যেনো গুড় করা না হয়, আখ যেনো সুগার মিলে যায় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে আমির হোসেন আমু বলেন, ‘দেশে সার বিতরণে কোনো সমস্যা নেই।’
কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী: ডিসিদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয় যে, সাদাজাতের নারকেল চারার দাম কমানোর। বর্তমানে প্রতিটি চারার দাম ৫শ টাকা। এ চারায় তিন বছরের মধ্যে ফলন ধরে। মন্ত্রী জানান, ৫শ টাকা দামেই চারা কেনা হয় এবং সে দামেই বিক্রি করা হয়। আয়-ব্যয় সমন্বয় রাখতে এটি করা হয়েছে। তবে আগামী তিন বছর পর চারার দাম কমবে। মন্ত্রী জানান, সার-বীজ সংকট নেই। কিছু খাল বা ছোটখাট নদী বিএডিসির মাধ্যমে কৃষি মন্ত্রণালয় খনন করে থাকে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম: জেলা প্রশাসকদের প্রতি জনগণের কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যমান অর্জনে মাঠপর্যায়ে সেবা দানের পরিবেশ সৃষ্টিতে আরো সচেষ্ট হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মন্ত্রী বলেছেন, গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে জেলা ও বিভাগের বড় বড় সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীদের বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে চিকিত্সা প্রদান করা হয় বলে সরকারি হাসপাতালে রোগীর চাপ বেশি থাকে। তাই গ্রামের সাধারণ মানুষ যেন সহজে চিকিত্সা সুবিধা পেতে পারেন এজন্য সরকারের কর্মসূচিগুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি একথা বলেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম এতে সভাপতিত্ব করেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার অসমাপ্ত কাজ সমাপনের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তারই নির্দেশনায় বর্তমান সরকারের সময় দেশের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সূচকে অভূতপূর্ব অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে আজ বাংলাদেশের অর্জন রোল মডেল হিসাবে পরিগণিত। বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সরকারের চলমান প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসকদের সহযোগিতা কামনা করে মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘মাঠ পর্যায়ে সরকারের প্রতিনিধি জেলা প্রশাসকগণ। বর্তমান মেয়াদের অবশিষ্ট কর্মসূচিগুলো যেন যথাসময়ে সম্পন্ন হয় সেদিকে তাদেরকে লক্ষ্য রাখতে হবে।’
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের: আগামী জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে সরকারের বড় বড় প্রকল্পের কাজ ত্বরান্বিত করতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দিয়েছেন মন্ত্রী। একই সঙ্গে তিনি সরকার বিব্রত হয় এমন কোনো কাজ না করা, ভিআইপি ও মন্ত্রীদের প্রটোকল কমিয়ে কাজে বেশি মনোযোগী হওয়ারও নির্দেশ দেন। জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের কার্য-অধিবেশন শেষে মন্ত্রী সাংবাদিকদের এ কথা জানান। এ সময় রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকও উপস্থিত ছিলেন।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, সেতু বিভাগ ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে জেলা প্রশাসকদের এ কার্য-অধিবেশন হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম এতে সভাপতিত্ব করেন। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করতে গিয়ে জেলা প্রশাসকরা রাজনৈতিক কোনো চাপের কথা বলেছেন কিনা- জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘এ ধরনের কোনো কথা ডিসি সাহেবরা বলেননি। আমাদের এরিয়ার বাইরে তারা কোনো প্রশ্ন করতে যাননি। তবে রুলিং পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি তাদের বলেছি, সরকার বিব্রত হয় এমন কিছু আপনারা করবেন না, আর কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করবেন না। এই কথাটা আমি স্পষ্ট বলেছি।’
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এটাও বলেছি আপনারা মন্ত্রী-ভিআইপিদের এত প্রটোকল দিতে গেলে কাজ করবেন কখন। সারাদিন যদি ডিসি-এসপি মন্ত্রীর পিছনে ঘোরে তাহলে সে কাজ করবে কখন।’ ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমরা বলেছি, আমাদের প্রটোকলের দরকার নেই। প্রটোকল কমানো উচিত। ওরা কাজ করবে কীভাবে, আর সরকারের শেষ বছর, এখন অনেক কাজ ডিসি-এসপিদের।’
বর্তমান সরকারের মেয়াদে এটাই শেষ ডিসি সম্মেলন। নির্বাচনকে সামনে রেখে ডিসিদের কী নির্দেশনা দিয়েছেন- জানতে চাইলে সেতুমন্ত্রী বলেন, ‘এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার। নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণার জন্য ৩ মাসের মতো সময় আছে। কাজেই এ সময়ে তাদের প্রতি সরকারের যে জেনারেল ম্যাসেজ সেটা সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রী অলরেডি ডিসি সম্মেলন উদ্বোধনকালে দিয়েছেন। এর সঙ্গে সরকার আমরা মন্ত্রীরা সবাই একমত। কাজেই সরকার প্রধানের ম্যাসেজটাই আমাদের ম্যাসেজ। এর বাইরে উই ক্যান নট থিংক বেয়ন্ড দ্যাট।’
তিনি বলেন, ‘রমজানের ঈদের সময়ও তারা দায়িত্ব পালন করেছেন এজন্য আমরা স্বস্তিদায়ক ঘরমুখী ঈদযাত্রা দিতে পেরেছি। সফল করতে পেরেছি। এবারও গতবারের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ঈদুল ফিতরের মতো মানুষ যাতে স্বস্তিতে বাড়ি যেতে পারে, আবার স্বস্তিতে কর্মস্থলে ফিরে আসতে পারে, যানজটের কারণগুলো দূরীকরণে তাদের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে বলেছি।’
পানি সম্পদ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু: মন্ত্রীর কাছে ১৩টি এলাকা থেকে জেলা প্রশাসকগণ নদী খনন, নদীর লবণাক্ততায় ফসলহানি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন ডিসিরা। মন্ত্রী ডিসিদের সুপারিশের প্রেক্ষিতে বলেন, সুপারিশগুলো পৃথক হলেও সারাদেশের চিত্র প্রায় অভিন্ন। তিনি বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোর উন্নয়ন ও দক্ষ মানব সম্পদের ঘাটতি সত্ত্বেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তার মতে যেসব টেকনিক্যাল মন্ত্রণালয় রয়েছে সেগুলোতে কারিগরি জ্ঞান সম্পন্ন কর্মকর্তা পদায়ন করা উচিত। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ভূমি অধিগ্রহণসহ লম্বা প্রক্রিয়ায় বছরের উল্লেখযোগ্য সময় নষ্ট হয়ে যায়। ফলে নয় মাসে উন্নয়ন বাস্তবায়নের হার গড়ে ৪০ শতাংশ হলেও পরবর্তী তিন মাসে তা প্রায় ১০০ শতাংশে উন্নীত হয়ে যায়। এ জন্য টেন্ডারসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজের প্রস্তুতি এগিয়ে রাখার নির্দেশনা দেন তিনি। তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুমে নদী ভাঙন, পানি ব্যবস্থাপনাসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন: মন্ত্রী বলেন, জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ডিসিদের কোনো সমন্বয়হীনতা নেই। তাদের মধ্যে কখনো মতদ্বৈধতা হলেও তা বড় কিছু নয়। ডিসি সম্মেলনের কার্য-অধিবেশন শেষে খন্দকার মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ডিসিদের সমন্বয়হীনতা আছে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘মতদ্বৈধতা তো আমার সঙ্গে আমার সচিবেরও হয়, সেইটা তো বড় বিষয় না।’ মন্ত্রী বলেন, ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনারদের সঙ্গে আমরা সরাসরি সম্পৃক্ত। কারণ স্থানীয় সরকারগুলোর নিয়ন্ত্রকই হচ্ছেন তারা। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা নিয়ন্ত্রণ করছেন ডিসিরা। তাদের সঙ্গে এই মন্ত্রণালয় প্রত্যেকটা কাজে জড়িত। সেই সুবাদে তাদের যেসব সাজেশন সেগুলো রিলেভেন্ট আমাদের কাছে। প্রত্যেকটা প্রোজেক্ট, প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করতে হলে তাদের সাজেশন আমাদের অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করতে হয়।’
পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ: মন্ত্রী বলেন, ‘পাহাড় কাটা, বনের জমি লিজ নেওয়া, বনভূমির অবৈধ দখল, নদী দখল, নদী দূষণ নিয়ে ডিসিদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তারা কিভাবে এগুলোর সঙ্গে সমপৃক্ত হতে পারে সেটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বান্দরবানের পাহাড় ধস নিয়ে কথা হয়েছে জানিয়ে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘পাহাড় ধসে মারা যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে গাছগুলো আমরা কেটে ফেলেছি। অন্যান্য জায়গায় পাহাড়গুলো পাথুরে থাকে, কিন্তু আমাদের এখানে মূলত বালুমাটি। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে না পারলে এই সমস্যা থেকে যাবে। কক্সবাজারে পাঁচ হাজার একর বন ধ্বংস হওয়ায় সেখানের পরিবেশ সংকটাপন্ন। ডিসিরা এজন্য পুনরায় বনায়নের কথা বলেছেন।’
খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম: হতদরিদ্র মানুষদের জন্য বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি ভিজিডি, ভিজিএফসহ ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে যেন কোনো অভিযোগ না উঠে সে জন্য কঠোর নজরদারি করতে ডিসিদের নির্দেশ দিয়েছেন মন্ত্রী।
ডিসিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে খাদ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের আরও বলেন, ‘ভিজিডি, ভিএসএফ, খাদ্যবান্ধবসহ সরকার কয়েকটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তার ওপর নজরদারি বাড়াতে ডিসিদের নির্দেশ দিয়েছি।’
তিনি জানান, সরকার ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে ‘জিরো হাঙ্গার পলিসি’ গ্রহণ করেছে। এই পলিসি সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য ডিসিদের নির্দেশ দেওয়া হয়।’
সূত্র: ইত্তেফাক